বেগম রোকেয়ার আলোকবর্তিকাই নারী সমাজকে পথ দেখিয়েছে
09-12-20 (02:01)
09-12-20 (02:01)
[ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
দর্শন বিভাগের
অনারারি অধ্যাপক
ও ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
রোকেয়া চেয়ার
হাসনা বেগম (১৯৩৫-
২০২০) সম্প্রতি (১
ডিসেম্বর) প্রয়াত
হয়েছেন। তিনি
নারী আন্দোলনের
সঙ্গে দীর্ঘ সময়
যুক্ত থেকে
সামাজিক, নারী
অধিকার বিষয়ে
কাজ করেছেন।
দর্শন, নীতিশাস্ত্র,
নারীর সমস্যা ও
অধিকার বিষয়ে
তাঁর বহু প্রবন্ধ ও
গ্রন্থ প্রকাশিত
হয়েছে। হাসনা
বেগম বাংলাদেশ
এশিয়াটিক
সোসাইটির
সাধারণ
সম্পাদকের
দায়িত্ব পালন
করেছেন। তাঁর
স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা
জানিয়ে আজ
রোকেয়া দিবসে (৯
ডিসেম্বর) ২০০৮
সালে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
উইমেন অ্যান্ড
জেন্ডার স্টাডিজ
বিভাগে দেওয়া
রোকেয়া স্মারক
বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত
ও বেগম রোকেয়া
প্রসঙ্গে তাঁর
মূল্যায়নের অংশটি
প্রকাশিত হলো।]
এই উপমহাদেশের
নারীমুক্তির
স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম
বেগম রোকেয়া
(১৮৮০-১৯৩২) একজন
সমাজসংস্কারক,
নারীশিক্ষা প্রচারক
এবং সাহিত্যিক রূপে
বাংলাদেশের
নবজাগরণের সূত্রপাতের
অগ্রদূত হিসেবে জাতীয়
ভিত্তিতে সশ্রদ্ধ
স্বীকৃতি পেয়েছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব
বরেণ্য মহান ব্যক্তিত্ব
মানবজাতিকে যথার্থ
অর্থে সভ্যতার আলোর
পথে এগিয়ে নিয়ে
যাওয়ার চেষ্টা
করেছেন, তাঁদের
প্রত্যেককেই সমকালীন
সামাজিক ও ধর্মীয়
গোঁড়ামির তমসাচ্ছন্নতা
থেকে দুঃসাহসী
পদক্ষেপে বেরিয়ে
আসতে হয়েছে। বেগম
রোকেয়ার জীবনী
পাঠেও জানা যায়,
বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার
সাহায্যে ও সর্বজনীন
কল্যাণের আদর্শে
অনুপ্রাণিত হয়ে পথ
চলতে গিয়ে তাঁকেও
নানা প্রকারের বাধা-
বিপত্তির সম্মুখীন হতে
হয়েছিল।
সমাজসংস্কারক ও
সাহিত্যিক বেগম
রোকেয়া তাঁর
কর্মক্ষমতা ও তিতিক্ষা,
আদর্শের মহত্ত্ব,
স্পষ্টতর আত্মত্যাগ ও
পরার্থপরতা, সহনশীলতা
ও দৃঢ়তা, সর্বোপরি তাঁর
অসীম সাহসিকতা এবং
অন্তর্দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও
প্রজ্ঞার গভীরতা
প্রভৃতির বিবেচনায়
একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব
ছিলেন।
উন্নত বিশ্বের
নারীমুক্তি ও
নারীজাগরণের উত্তাল
ঢেউয়ের আলোড়ন
আমাদের নারীসমাজের
কাছে পৌঁছাবার বহু
পূর্বেই বেগম রোকেয়ার
সাহিত্যকর্মে তাঁর
যুক্তিনির্ভর ও সাহসী
বক্তব্য, ব্যক্তিগত
জীবনের কর্মকাণ্ড এ
দেশের নারীসমাজকে
নারীর অধিকার সম্বন্ধে
সচেতন করে তোলে এবং
এই প্রাপ্য অধিকার
আদায়ের সংগ্রামে
অনুপ্রেরণা দেয়। এ
দেশের নারীসমাজ
তাঁরই আলোকবর্তিকার
দ্বারা ধীরে ধীরে
অন্ধকার থেকে
আলোকিত জীবনের
দিকে অগ্রযাত্রা শুরু
করতে সক্ষম হয়েছে, এ
কথা বিনা দ্বিধায় আজ
আমরা বলতে পারি।
২.
নারীশিক্ষা, নারীর
অর্থনৈতিক,
রাজনৈতিক ও
প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের
বিষয়গুলো বেগম
রোকেয়ার রচনার মূল
বক্তব্য হিসেবে
লক্ষণীয়। অবরোধ প্রথা
ও ধর্মীয় অনুশাসনের
কারণে নারী যুগে যুগে
শিক্ষার সুযোগ থেকে
বঞ্চিত হয়েছে। আর
শিক্ষার অভাবে
আমাদের নারীসমাজ
জ্ঞানের আলোর সন্ধান
পায়নি। এই জ্ঞানের
অভাবে নারী
আত্মমর্যাদা ও
আত্মপ্রত্যয় অর্জন করতে
সক্ষম না হওয়ায়
নারীকে পুরুষের
মুখাপেক্ষী হয়ে পুতুলের
মতো জীবন যাপন করতে
হয়। তাই নারীকে শিক্ষা
অর্জন করে
অর্থনৈতিকভাবে
স্বাবলম্বী হওয়ার কথাই
বেগম রোকেয়া বলেন।
সমাজের সব স্তরে
নারীর অধস্তনতাকে দূর
করতে হলে
নারীশিক্ষার প্রসার ও
অবরোধ প্রথা দূর করা
যে আশু প্রয়োজন, সে
কথাও রোকেয়া
সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত
করেছেন।
আমরা বেগম রোকেয়ার
স্বপ্ন-রাষ্ট্রের রূপরেখা
পাই তাঁর ‘সুলতানার
স্বপ্ন’ রচনায়। এই স্বপ্ন-
রাষ্ট্রের কর্ণধার একজন
নারী এবং প্রশাসনিক ও
অন্যান্য কর্মকর্তা ও
কর্মচারী নারী।
পুরুষদের জন্য আছে
‘মর্দানা’ (‘জেনানা’-এর
বিপরীত), অর্থাৎ
পুরুষদের অন্তঃপুর,
যেখানে তাঁরা
অবরোধবাসী নাগরিক।
তাঁদের কাজ ঘর-
গৃহস্থালি দেখা ও
সন্তান লালন-পালন করা
এবং যেসব কাজে
কায়িক শ্রম আবশ্যক,
সেসব কাজ নারীদের
নির্দেশনায় সম্পাদন
করা। রাষ্ট্রীয় আর সব
কাজ করেন নারীরা। এই
নারীস্থানে কোনো
অভাব নেই, যুদ্ধবিগ্রহ
নেই, স্বাস্থ্য রক্ষায়
সুব্যবস্থা আছে
(মেয়েদের স্বাস্থ্য
রক্ষার্থে
বাল্যবিবাহকে
বেআইনি ঘোষণা করা
হয়েছে), আছে
বৈজ্ঞানিক উপায়ে
চাষাবাদের ব্যবস্থা। এই
নারীস্থানের ধর্মের
কথা বলতে গিয়ে ভগিনী
সারার বক্তব্যে বেগম
রোকেয়ার ধর্মচেতনার
সারমর্মটি জানা যায়,
‘আমাদের [নারীস্থানের
নাগরিকদের] ধর্ম প্রেম
ও সত্য। আমরা পরস্পরকে
ভালবাসিতে বাধ্য এবং
প্রাণান্তেও সত্য ত্যাগ
করিতে পারি
না।’ (রোকেয়া
রচনাবলি, পৃ.১১৩। )
নারীস্থানের সঙ্গে
আমাদের রাষ্ট্রীয় ও
সামাজিক ব্যবস্থার
বৈপরীত্যকে বোঝাতে
গিয়ে আমাদের দেশের
নারীর বাস্তব অবস্থা
সম্বন্ধে নারীস্থানে
ভগিনী সারাকে বেগম
রোকেয়া বলেন,
‘সামাজিক বিধি
ব্যবস্থার উপর আমাদের
[নারীদের] কোন হাত
নাই। ভারতে পুরুষজাতি
প্রভু-তাহারা সমুদয় সুখ
সুবিধা ও প্রভুত্ব
আপনাদের জন্য হস্তগত
করিয়া ফেলিয়াছে, আর
সরলা অবলাদের
অন্তঃপুররূপ পিঞ্জরে
আবদ্ধ রাখিয়াছে।
উড়িতে শিখিবার পূর্বেই
আমাদের ডানা কাটিয়া
দেওয়া হয়-তদ্ব্যতীত
সামাজিক রীতিনীতির
কত শত কঠিন শৃঙ্খল পদে
পদে জড়াইয়া
আছে।’ (রো. র. পৃ.১০৩)
রোকেয়ার মতে,
আমাদের দেশে যেমন
নারীসমাজের
কর্মক্ষমতাকে রাষ্ট্রীয়
কর্মকাণ্ডে ব্যবহার না
করে অর্ধেক জনশক্তির
যে অপচয় করা হয়,
ভগিনী সারাদের
নারীস্থানে পুরুষের
কর্মক্ষমতার সে রকম
কোনো অপচয় করা হয়
না। নারীস্থানের
অর্ধেক জনসম্পদ পুরুষকে
তাঁদের সাধ্যমতো
দেশের উন্নতির জন্য
কাজে লাগানো হয়।
নারীস্থানের নারী
রাষ্ট্রপরিচালকেরা
পুরুষসমাজের
কর্মক্ষমতাকে অপচয়
হতে না দিয়ে রাষ্ট্রের
মঙ্গলের জন্য সেই
কর্মক্ষমতাকে কাজে
লাগানোর ব্যবস্থা
করেছেন। এই নারী
পরিচালকদের
সুবিবেচনা ও দূরদৃষ্টির
প্রশংসা করতেই হয়।
ভগিনী সারা
নারীস্থানে
নারীশিক্ষা সম্বন্ধে
বলতে গিয়ে বলেন,
‘মহারানী [রাষ্ট্রের
প্রধান পরিচালক]
সঠিকভাবে অনুধাবন
করেছিলেন শিক্ষা
বিনা নারী জাতির
কোনও প্রকারের
ক্ষমতায়ন সম্ভবপর নয়।’
এই অনুধাবনের ফলে
‘...অচিরে গভর্মেন্ট পক্ষ
হইতে অসংখ্য বালিকা
স্কুল স্থাপিত হইল।
এমনকি পল্লীগ্রামেও
উচ্চশিক্ষার অমিয়-
স্রোত প্রবাহিত হইল।
শিক্ষার বিমল
জ্যোতিতে কুসংস্কার
রূপ অন্ধকার তিরোহিত
হইতে লাগিল এবং
বাল্যবিবাহ প্রথাও
রহিত হইল। একুশ বৎসর
বয়ঃক্রমের পূর্বে কোন
কন্যার বিবাহ হইতে
পারিবে না-এই আইন হইল।
আর এই কথা, এই
পরিবর্তনের পূর্বে
আমরাও [নারীস্থানের
নারীরা] আপনাদের মত
কঠোর অবরোধে বন্দিনী
থাকিতাম।...কয়েক
বৎসরের মধ্যে আমাদের
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়
হইল...’ (রো. র. পৃ.১০৬)
বেগম রোকেয়ার
‘পদ্মরাগ’
উপন্যাসটি তাঁর
নারী ভাবনার
আরেকটি উৎকৃষ্ট
উদাহরণ। এই
উপন্যাসের
নায়িকা সিদ্দিকা
ওরফে জয়নবের
উক্তি থেকে
রোকেয়ার
নারীবাদী
মতবাদের সুস্পষ্ট
ধারণা পাওয়া যায়।
সিদ্দিকার প্রতিটি
বক্তব্য মুক্তিবুদ্ধির
পরিচয় দেয়।
এখানে দ্রষ্টব্য যে,
নারীশিক্ষার প্রভাবে
অন্তঃপুরের নারীরা
অবরোধপ্রথা ভঙ্গ করে
বহির্জগতে স্থান
অধিকার করতে সক্ষম হন।
আর এভাবে শিক্ষিত
এবং বিজ্ঞানমনস্ক
নারীসমাজ অর্থনৈতিক,
রাজনৈতিক ও
সামাজিক ক্ষমতায়
বলীয়ান হয়ে রাষ্ট্রের
সব কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে
পরিচালনা করতে
পারেন।
রোকেয়ার স্বপ্নরাজ্য
নারীস্থানে নারীরা
বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে
বিজ্ঞানের নানাবিধ
পরীক্ষা-নিরীক্ষার
মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে
‘জলধর বেলুন’ আবিষ্কার
করে ‘জলধরকে ফাঁকি
দিয়া তাঁহারা বৃষ্টিজল
করায়ত্ত, করেন।’ এই
জলধর বেলুন ব্যবহারের
মাধ্যমে কৃষিকাজে
উন্নতি সাধন সম্ভব হয়।
নারী বিজ্ঞানীরা
সূর্যতাপ সংগ্রহ করার
যন্ত্রও আবিষ্কার করেন
এবং সেই জ্বালানি
প্রয়োজনমতো ব্যবহার
করার ব্যবস্থা করেন।
১৯০৫ সালেই বেগম
রোকেয়া সৌরশক্তি
সংগ্রহ করা এবং কৃত্রিম
মেঘ তৈরি করা যে
সম্ভব, সে কথা কল্পনা
করেছিলেন, ভাবলেও
আমাদের বিস্মিত হতে
হয়।
বেগম রোকেয়ার
‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসটি তাঁর
নারী ভাবনার আরেকটি
উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই
উপন্যাসের নায়িকা
সিদ্দিকা ওরফে
জয়নবের উক্তি থেকে
রোকেয়ার নারীবাদী
মতবাদের সুস্পষ্ট ধারণা
পাওয়া যায়। সিদ্দিকার
প্রতিটি বক্তব্য
মুক্তিবুদ্ধির পরিচয় দেয়।
নারীর পুরুষের মতো
সমান অধিকার সুযোগের
বিষয়টি সম্বন্ধে অত্যন্ত
সচেতন তাঁর বক্তব্য।
প্রকারান্তরে
সিদ্দিকার বক্তব্য তাঁর
নিজেরই উক্তি, কেবল
উপন্যাসের নায়িকার
উক্তি জনসাধারণের
তথা পাঠকদের মনে
সহজেই সহমর্মিতার
সঙ্গে স্থান করে নিতে
পারবে, সেই আশায়
সিদ্দিকার উক্তি
হিসেবে সেগুলো
প্রকাশ করা হয়।
সিদ্দিকা নিজেকে
নারীসমাজের সামনে
একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন
করার উদ্দেশ্যেই
তারিণী ভবনে অবস্থান
করে স্বাধীনতা অর্জন
করেছে।
নারীশিক্ষার প্রসারের
প্রচেষ্টায় রোকেয়া
বাস্তব জীবনে নিজেই
কলকাতায় একটি
মেয়েদের স্কুল
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এবং জীবনের শেষদিন
পর্যন্ত সেই স্কুল
পরিচালনায় নিয়োজিত
ছিলেন। এই স্কুল
পরিচালনার সঙ্গে
সঙ্গে শিক্ষার শক্তিতে
বলীয়ান আত্মনির্ভর ও
আত্মসচেতন নারীসমাজ
গড়ে তোলার বিষয়টির
গুরুত্বকে জনগণের
দ্বারা উপলব্ধি ও
অনুধাবন করার লক্ষ্যে
তিনি তাঁর লেখনী সচল
রেখেছিলেন।
রোকেয়ার সমসাময়িক
ভারতে স্ত্রীশিক্ষা
যখন সমাজে ভীষণ
আতঙ্কের সৃষ্টি
করেছিল আর
স্ত্রীশিক্ষার ধারণাকে
নিয়ে যখন সন্দেহের
আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল,
তখনো কিন্তু তিনি সব
সমালোচনা ও বাধার
সম্মুখীন হয়েও দৃঢ়চিত্তে
এবং অত্যন্ত
যুক্তিসহকারে তাঁর
জোরালো বক্তব্য
প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি লেখেন, ‘শিক্ষা
স্ত্রীলোক-পুরুষ
নির্বিশেষে সর্বদা
বাঞ্ছনীয়। স্থলবিশেষে
অগ্নি গৃহদাহ করে
বলিয়া কি কোন গৃহস্থ
অগ্নি বর্জন করিতে
পারে?’ (রো. র. পৃ.২০৭)
আবার দেখি রোকেয়া
তাঁর ‘আশাজ্যোতি’
প্রবন্ধে লেখেন,
আলিগড়ে স্ত্রীশিক্ষার
আয়োজনের খবর তাঁকে
আশার আলো
দেখিয়েছে। একই সঙ্গে
এই ঘটনার দুই বৎসর পূর্বেই
যে তিনি মেয়েদের জন্য
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠা করার
প্রয়োজনীয় বিষয়টি
উত্থাপন করেছিলেন,
সে কথা আমাদের স্মরণ
করিয়ে দেন। এই প্রবন্ধে
তিনি লেখেন,
‘স্ত্রীলোকদিগকে
পুরুষেরা সর্বদা হীন
বলিয়া থাকেন, তাই
অবলারা নিজেদের
নিতান্ত মেধাহীন
ভাবিয়া ক্রমে নিরুৎসাহ
হইয়া পড়িয়াছে, তাহারা
জ্ঞানচর্চার দিকে
সহসা অগ্রসর হইতে চাহে
না। কোন
ভালোলোককে ক্রমাগত
পাগল বলিলে সত্যই সে
পাগল হইয়া যায়।
নারীজাতি কি
বাস্তবিকই হীনবুদ্ধি?
না, বরং রমণী প্রতিভার
অধীশ্বরী। ইহা
সর্বাদিসম্মত নারীই
প্রথমে জ্ঞানফল
চয়ন...করিয়াছেন, পরে
পুরুষ তাহার (...প্রদত্ত ফল
প্রাপ্ত
হইয়াছেন।)’ (অগ্রন্থিত
রোকেয়া, পৃ.৩৪)
রোকেয়া এই প্রবন্ধেই
আরও বলেন, ভারতের
নারীদের পুরুষের সঙ্গে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার
সুযোগ দেওয়া হয় না।
অথচ এই অবস্থায়ও
মেয়েরা সুযোগ পেলে
যে পুরুষের তুলনায়
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে
পারে, সে বিষয়টিও
তিনি উদাহরণ
উল্লেখপূর্বক আলোচনা
করেন। আর আমরা দেখি
‘প্রেম রহস্য’ প্রবন্ধে
বেগম রোকেয়া
কৌতুকের আড়ালে
নারীকে পুরুষের চেয়ে
শ্রেয় বলে দাবি করেন।
রোকেয়ার ‘সুলতানর
স্বপ্ন’ রচনায় তাঁর
স্বপ্নের সেই আদর্শ-
রাষ্ট্রের চালিকা
শক্তি নারীসমাজকেই
যে হতে হবে, সেই প্রত্যয়
প্রকাশের প্রতি এই
বিশ্বাসই তাঁকে
প্রণোদিত করে।
উত্তরাধিকারিত্বের
ব্যাপারে বেগম
রোকেয়া তাঁর
সময়ে সম্পত্তিতে
নারীর সমান
অধিকারের কথা
না বললেও
আমাদের বর্তমান
পরিবর্তিত
সামাজিক
বাস্তবতার
নিরিখে নারীর এই
বিষয়ে সমান
অধিকারের
প্রশ্নটি এসেই যায়।
৩.
বেগম রোকেয়ার ধর্ম
সম্বন্ধে আলোচনায়
প্রথমেই তাঁর নিজের
লেখা থেকেই উদ্ধৃতি
দিতে হয়। ‘পদ্মরাগ’-এর
প্রারম্ভেই লেখকের
‘নিবেদন’-এ তিনি একটি
গল্পের অবতারণা করে
তাঁর ধর্মচেতনাকে
সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ
করেন। গল্পটি হলো:
একজন ধর্মপিপাসু
ব্যক্তি একজন দরবেশের
কাছে যোগ শিক্ষা
করতে চাইলে সেই
দরবেশ তাকে তাঁর
নিজের গুরু এক হিন্দু
সাধুর কাছে নিয়ে
গেলেন। সেই হিন্দু সাধু
আবার তাকে তাঁর গুরু এক
মুসলমান দরবেশের
কাছে নিয়ে যেতে চান।
শিক্ষার্থী দরবেশকে
এই হিন্দু মুসলমানে
মিশামিশির কারণ
জিজ্ঞাসা করায়
দরবেশ বলেন, ‘ধর্ম একটি
ত্রিতল অট্টালিকার
ন্যায়। নীচের তলায়
অনেক কামরা, হিন্দু-
ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি
বিভিন্ন শাখা, মুসলমান-
শিয়া, সুন্নী প্রভৃতি
নানা সম্প্রদায়, ঐরূপ
খ্রীষ্টান-রোমান-
ক্যাথলিক, প্রটেষ্টান্ট
ইত্যাদি। তাহার উপর
দ্বিতল দেখ, কেবল
মুসলমান-সবই মুসলমান;
হিন্দু-সবই হিন্দু ইত্যাদি।
তাহার উপর ত্রিতলে
উঠিয়া দেখ-একটি কক্ষ
মাত্র, কামরা বিভাগ
নাই অর্থাৎ মুসলমান,
হিন্দু, কিছুই নাই-সকলেই
এক প্রকার মানুষ এবং
উপাস্য কেবল এক
আল্লাহ [ঈশ্বর]।’... (রো. র.
পৃ.২৫৯)
মানুষে মানুষে বৈষম্যে
অবিশ্বাস করে
ব্যক্তিস্বার্থ ও
গৌষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে
গিয়ে মানুষের দিকে
তাকাতে সক্ষম হলে মনে
হয় সব মানুষই এক এবং সব
ধর্মই এক। মনে হবে,
ধর্মে ধর্মে আর কোনো
ভেদাভেদ নাই। এই
গল্পের অবতারণা
থেকেই বুঝা যায় যে
রোকেয়ার কাছে
‘ধর্মের জন্য মানুষ নয়,
মানুষের জন্যই ধর্ম’। সব
ধর্মের মানুষই সত্য ও
প্রেমে বিশ্বাসী হয়ে
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
করতে পারে।
উত্তরাধিকারিত্বের
প্রশ্নে বেগম রোকেয়া
পুত্র-কন্যার বা পুরুষ-
নারীর সমান
অধিকারের কথা বলার
কোনো অবকাশ পাননি।
উত্তরাধিকারিত্বের
ব্যাপারে বেগম
রোকেয়া তাঁর সময়ে
সম্পত্তিতে নারীর সমান
অধিকারের কথা না
বললেও আমাদের
বর্তমান পরিবর্তিত
সামাজিক বাস্তবতার
নিরিখে নারীর এই
বিষয়ে সমান
অধিকারের প্রশ্নটি
এসেই যায়। আজকাল
মেয়েদের অনেকেই
অর্থনৈতিক ও সামাজিক
কর্মকাণ্ডে পুরুষের
মতোই অংশগ্রহণ করছেন
এবং সেই সঙ্গে সম্পৃক্ত
দায়দায়িত্বও তাঁদের
বহন করতে হচ্ছে। এমন
অবস্থায় নারীসমাজের
পক্ষে
উত্তরাধিকারিত্বের
ব্যাপারে সমান
অধিকারের দাবিটি
সময়োপযোগী। উপরন্তু,
বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত
বহু দেশেই বর্তমান সময়ে
সম্পত্তির
উত্তরাধিকারিত্বে
নারীর সম-অধিকার
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই
বিবেচনায়ও আমাদের
দেশের নারীদের পক্ষে
সম্পত্তির
উত্তরাধিকারিত্বে
সমান অধিকার দাবি
করার বিষয়টি
ন্যায়সংগত।
৪.
বাংলাদেশের নারী
সংগঠনগুলো এবং সচেতন
নারীসমাজ ১৯৭২-এর
বাংলাদেশের
সংবিধানপ্রদত্ত
জীবনের সর্বক্ষেত্রে
নারী-পুরুষের সম-
অধিকার আদায়ের
দাবিতে নানা
পদ্ধতিতে সোচ্চার
আন্দোলন করে এসেছে।
এই নারী সংগঠনগুলো
তাদের নারীবাদীয়
আদর্শ গঠনে বেগম
রোকেয়ার ধ্যানধারণার
দ্বারাই প্রেরণা
পেয়েছে। সংগঠনগুলোর
দাবির রূপরেখাও প্রণীত
হয় মূলত তাঁর
নারীভাবনায় মৌলিক
অবস্থান থেকেই।
সবশেষে আমাদের
বলতে হয়, বেগম
রোকেয়া আমাদের
দেশের নারীসমাজকে
নারীমুক্তির স্বপ্ন
দেখিয়েছেন এবং মুক্ত
নারীসমাজের
কর্মকাণ্ডের কাল্পনিক
উৎকর্ষের বিবরণ দিয়ে
আমাদের নারীমুক্তির
জন্য সংগ্রাম করার
প্রেরণা জুগিয়েছেন।
আমরা সেটুকু স্বাধীনতা
ও অধিকার এবং সেই
অধিকার আদায়ের
সুযোগ ইতিমধ্যে অর্জন
করতে সমর্থ হয়েছি। সে
জন্য কৃতিত্বের
অনেকখানিই তাঁরই
প্রাপ্য, আর প্রাপ্য তাঁর
উপযুক্ত শিষ্য বেগম
সুফিয়া কামাল এবং
অন্য পথপ্রদর্শক
নারীদের। ভবিষ্যতেও
জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে সমসুযোগ ও সম-
অধিকার অর্জনের
সংগ্রামে আমাদের
নারীসমাজ তাঁদের মতো
সুযোগ্য পথের দিশারি
পাবেন, সেই আশা
নিয়েই আমাদের এই
সংকটময় পথচলা।
[১০ই ডিসেম্বর, ২০০৮
রোকেয়া স্মারক
বক্তৃতা, উইমেন অ্যান্ড
জেন্ডার স্টাডিজ
বিভাগ, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়।]
হাসান বেগম (১৯৩৫-১৯২০)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
দর্শন বিভাগের
অনারারি অধ্যাপক ও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
রোকেয়া চেয়ার